পাহাড়ের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘ যারা ছুতে চান তাদের জন্য সাজেক এক স্বর্গ রাজ্য । রাঙামাটির একেবারে উত্তরে সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। কিন্তু যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে সাজেক এর সৌন্দর্যের ব্যাপারে মোটামুটি সবারই ধারনা আছে মনে করি। আপাতত শুধু ট্রিপ এর বিস্তারিত আলোচনা করি।
কিভাবে যাবেন সাজেকঃ
- এসি বাস এ খাগড়াছড়ি যেতে চাইলে বেশ আগে থেকেই যাওয়া-আসা টিকেট কেটে রাখতে হবে। কারন এসি বাস মাত্র একটাই। সেইন্টমার্টিন পরিবহন। এছাড়া নন — এসি “শান্তি পরিবহন” এর যাওয়া যাবে। শান্তি পরিবহন এর সুবিধা এটি সরাসরি দিঘিনালা পর্যন্ত যায়। [ তবে বলে রাখা ভালো “শান্তি পরিবহন” এ কপাল খারাপ থাকলে আপনি মোটেও শান্তিতে যেতে পারবেন না। কিছু ড্রাইভার সারা রাত উচ্চ স্বরে গান চালাবে, যা আপনার পুরা ট্রিপ নস্ট করতে যথেষ্ঠ। তবে আশা করি সব বাস সেইম না , আমি যে কয়েকটায় গিয়েছি সেগুলো আমার ভাগ্য খারাপ ছিলো]
- যাওয়ার প্লান মোটামুটি এমনঃ ঢাকা > খাগড়াছড়ি (বাস) > দিঘীনালা (বাস/চান্দের গাড়ি)- বাঘাইহাট (চান্দের গাড়ি) — কাসলং (চান্দের গাড়ি) — মাসালং (চান্দের গাড়ি) — সাজেক
- সকালে শহরের শাপলা চত্বরে নেমে নাস্তা সেরেই রওনা দিতে হবে সাজেকের উদ্দ্যেশে। চান্দের গাড়ি পাবেন এখানেই। তবে পারলে আগে থেকেই গাড়ি রিজার্ভ করে রাখলে ভালো হবে। কারন ট্যুর সিজন এ ওখান থেকে জিপ পাওয়া একটু ঝামেলা, তার উপর ভাড়া অনেক বেশি চেয়ে বসবে। রুইলুই পর্যন্ত চান্দের গাড়ি দুইদিনের জন্য রিজার্ভ পাবেন ৫০০০-৭০০০ (দরদাম করে নিতে হবে , প্রথমে ১০০০০ ও চেয়ে বসবে)। দুই রকম জিপ পাবেন। সাদা “মাহিন্দ্রা”, এটা সবচেয়ে ভালো। একটু আরামে জেতে পারবেন তবে ভাড়া একটু বেশি পরতে পারে। আরেকটা আছে নরমাল জিপ। যাত্রা পথে থ্রিল চাইলে নিতে পারেন। শরীরের হাড়গোর শক্ত না থাকলে আর ভয়ঙ্কর ঝাকি না খেতে চাইলে এটা না নেয়াই ভালো । শাপলা চত্বরের একটু পেছনেই একটি ব্রিজ আছে, ব্রিজের পাশেই সিএনজি স্টেশন, ওখান থেকে সিএনজি রিজার্ভ করতে পারবেন।
- খাগড়াছড়ি -সাজেক ৩-৩.৫ ঘন্টা সময় লাগে
- যেতে বেশ কয়েকটি আর্মি চেকিং, লিস্টিং ইত্যাদির মধ্য দিয়ে জেতে হবে। মাঝের কিছুটা পথ আর্মি এস্করট এ যেতে হবে।
- খাগড়াছড়ি ঢুকতেই জিরো মাইল পয়েন্টে গাড়ি থামিয়ে আর্মির কাছে আপনার গাড়ির নাম্বার এবং কোথা থেকে আসছেন, কত জন , কি করেন এমন কিছু তথ্য দিতে হয়।
- দিঘীনালা বাস স্টেশন থেকে ৩ কিমি এগুলেই দিঘীনালা সেনানিবাস, এখানেও একি কিছু তথ্য দিতে হয়।
- দিঘীনালা সেনানিবাস থেকে ৭কিমি পরেই দশনাম্বার নামক এলাকায় পুলিশ ক্যাম্পে আপনাকে একই তথ্য দিতে হবে।
- দশনাম্বার থেকে আনুমানিক ৭/৮ কিমি পরেই বাঘেরহাট আর্মি ক্যাম্প,এখানে আপনাদের যেকোন একজন এবং ড্রাইভার নেমে নিজের নাম এবং ফোন নাম্বার দিতে হবে এবং অন্যান্য কিছু তথ্য দিতে হয়।।
- মাচালং বাজারের একটু আগেই রয়েছে আরেকটি আর্মি ক্যাম্প, এখানেও গাড়ির নাম্বার অথবা এই ধরনের কিছু তথ্যা দিতে হয়।
- এইগুলো সবই নিরাপত্তার স্বার্থে , তাই অবশ্যই সহযোগিতা করবেন কর্মীদের।
কি কি আছে ?
সাজেক আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি পাহাড়ী আদিবাসীদের দু’টি পাড়া আছে… রুই লুই এবং কংলাক পাড়া। অসাধারন সুন্দর দুইটি জায়গা। এই পাড়াটির উচ্চতা ১৭০০ ফুটের একটু বেশি।
রুইলুই হতে আরও প্রায় ৩ কিঃমিঃ কাঁচা রাস্তা পেড়িয়ে কংলাক পাহাড় (উচ্চতা ১৮০০ ফুটেরও বেশি) । এখানে “জলবুক কটেজ” পর্যন্ত চান্দের গাড়ী যায়। বাকিটা খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকখানি উঠতে হবে হেঁটে। তবে বৃষ্টি থাকলে রুইলুই থেকে কংলাক পর্যন্ত পুরোটা হেটেই যেতে হবে।
খুব ভোড়ে উঠে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ কংলাক পাড়ায়। পাহাড় থেকে মেঘের মাঝে দাড়িয়ে সুর্যদোয় না দেখলে বিশ্বাস করুন জীবনটাই বৃথা।
ট্রাকিং এর অভ্যাস / ইচ্ছা থাকলে সাজেক থেকে ফেরার পথে ঘুরে আসতে পারেন “হাজাছড়া ঝর্না”
খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১০ কিমি এর মত দূরে আলুটিলা গুহা । বেশ ভালো লাগবে।
কোথায় থাকবেন:
- ক্লাব হাউজ : উপজাতিদের জন্য সেনাবাহিনী নির্মাণ করে দিয়েছে।বড় হল রুম,ফ্লোরিং করে থাকতে হয়। প্রতিজন ১৫০-২৫০ টাকা খাবারের ব্যাবস্থা স্থানীয় রেস্তোরাঁয় করে নিতে পারবেন।
- সাজেক রিসোর্ট : সাজেকের রুইলুই পাড়ায় ঢুকে প্রথমেই রাস্তার বাম পাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতৃক নির্মিত সাজেক রিসোর্টের অবস্থান। পাঁচটি ফ্যামিলি থাকার মত ব্যাবস্থা রয়েছে এই রিসোর্টে। বুকিংঃ 01783969200, 01769302370
- রিসোর্ট রূনময়: এটিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত রিসোর্ট।এটি রুইলুই পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে,এর আশেপাশে কোন বসতি নেই।ভাড়া ৪৫০০-৫০০০ টাকা। বুকিংঃ 01783969200, 01769302370
- কংলাক এ আদি বাসিদের বাসিদের ঘরেও থাকতে পারেন। এখানে থাকতেই বেশি ভালো লাগবে। সবচেয়ে উচু থেকে সূর্যোদোয় দেখার জন্য রাতে তারা ভরা আকাশের নিচে বার বি কিউ এর জন্য।
বুকিংঃ +8801842380234 (বিজু)
https://www.facebook.com/Rock-Paradise-178674612509846
খরচঃ
আমরা ৬ জনের একটা গ্রুপ গিয়েছিলাম। ২ দিন এক রাত ছিলাম। আমাদের মাথা পিছু খরচ এর হিসেবটা দেয়া হল। এতে আপনাদের সম্ভাব্য খরচের ধারনা পাবেনঃ
১. ঢাকা — খাগড়াছড়ি (শান্তি পরিবহন নন এসি): ৫২০ + ৫২০ টাকা= ১০৪০ টাকা
২. খাওয়া দাওয়া পুরো ট্যুর এরঃ ৮০০ টাকা
৩. চান্দের গাড়িঃ ১১৬৬ টাকা (মোট ৭০০০ টাকা / ৬ জন)
৪. আদিবাসিদের বাড়িতে থাকা ঃ ২৫০ টাকা
৫. অন্যান্যঃ ২৫০ টাকা
মোটঃ ৩৫০৬ টাকা।
গুরুত্বপূর্ন তথ্যসমুহঃ
১. সাজেকে বিদ্যুৎ নেই,সবকিছু সোলারে চলে,এমনকি ল্যাম্পপোস্টও! সাথে মোবাইল, ক্যামেরার জন্য পর্যাপ্ত পাওয়ার ব্যাকআপ নিয়ে যাবেন।
২. রবি ছাড়া আর কোন নেটওয়ার্ক নেই। মাঝে মাঝে জিপি আর টেলিটক একটু পেতে পারেন।
৩. শান্তি পরিবহণ
– দিঘীনালা কাউন্টার-০১৮৫৫৯৬৬১৪,০১৮১৩২৬৮৯১৯
– কলাবাগান কাউন্টার -০১১৯০৯৯৪০০৮,০৪৪৭৭৭০১১৯১
– কমলাপুর কাউন্টার -০১১৯১১৯৭২৯৭
৪. ক্যাম্পিং করা যায় তবে আর্মি অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে।
৫. নিরাপত্তার তেমন কোনো সমস্যা নেই। আর্মি, বিজিবি আর পুলিশের সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই ভালো ।
৬. গ্রুপে গেলে মোটামুতি ২ দিন ১ রাত সব সহ ৩৫০০-৪৫০০ এর মধ্যেই কভার হবে।
৭. কমপক্ষে দুই-তিন ঘণ্টা আগে যেকোনো রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে। কারণ, রেস্টুরেন্টগুলো অর্ডার না পেলে কোনো ধরনের খাবার বা নাশতা প্রস্তুত করবে না।
৮. সাজেক ভ্রমনে আগে অবশ্যই মাথায় রাখবেন মশার বিষয়টি।যেকোন পাহাড়ি এলাকা ভ্রমনকালেই এবিষয়ে একটু প্রতিষেধক ক্রীম বা অন্যকোন ওষুধ সাথে রাখবেন। আর ফাস্ট এইড বক্স রাখাতো অত্যন্ত জরুরি।
[বিঃ দ্রঃ কিছু ছবি সরাসরি আমার নিজের ক্যামেরায় তোলা না। কয়েকটি অন্য সোর্স থেকে নিয়েছি দেখানোর জন্য]
সবশেষে বলব আমাদের দেশটা আসলে অনেক সুন্দর, ঘুড়ে আসুন যখনই সময় পান। নাগরিক যান্ত্রিকতার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে যাবে এই দেশটা ঘুড়লে।